শাহজালালে গ্রাউন্ডসেবায় বিরক্ত বিদেশি এয়ারলাইন্স
একটি এয়ারলাইন্স যেই বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করে সেখানকার চেক-ইন কাউন্টারের পাশে কর্মী দেওয়া থেকে শুরু করে ব্যাগেজ সেবা, কার্গো সেবা ইত্যাদি জায়গায় সর্বত্র পর্যাপ্ত কর্মী দেওয়ার কথা রয়েছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলারের। তবে, সংকটের কারণে পর্যাপ্ত কর্মী দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সে কারণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনা করা বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বিরক্ত।
সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক এয়ারলাইন্স এয়ার অ্যারাবিয়া যাত্রীদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবার জন্য প্রতি ফ্লাইটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে দুই হাজার ২০০ মার্কিন ডলার পরিশোধ করে এবং কার্গোর জন্য প্রতি কেজিতে অতিরিক্ত শূন্য দশমিক শূন্য সাত সেন্ট (মার্কিন ডলার) চার্জও প্রদান করে। এসব ব্যয় সত্ত্বেও বিমান তাদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য মাত্র দুই থেকে তিনজন কর্মী সরবরাহ করে। বিমানবন্দরে একটি এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একটি স্টেশন ম্যানেজার বা কাউন্টার সুপারভাইজারই যথেষ্ট। তবে, বিমানের পর্যাপ্ত কর্মী না থাকায় এয়ার অ্যারাবিয়াকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৩০ জনেরও বেশি নিজস্ব কর্মী নিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে। একইভাবে ইন্ডিগো এয়ার বিমানবন্দরে ২৫ জন এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স ৬০ জন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।
বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো জানায়, নিয়মিত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ দিলেও বিমান পূর্ণাঙ্গ সাপোর্ট দিতে পারছে না। অনেক অনুরোধ করেও কর্মী পাওয়া যায় না। ফ্লাইটের আগে সহযোগিতা করার জন্য তারা একজন বা সর্বোচ্চ দুজনকে অ্যাসাইন করে থাকে, যা একটি বড় ফ্লাইটের জন্য পর্যাপ্ত নয়।
এদিকে, বিমানের বিরুদ্ধে লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ে ব্যর্থতার অভিযোগ নতুন নয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ চারটি গণশুনানিতে বিমানের ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং (গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং) নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন যাত্রীরা। যাত্রীদের অভিযোগ, দক্ষ জনবল ও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে তারা সময়মতো ব্যাগেজ পাচ্ছেন না। এ ছাড়া ব্যাগেজ কাটাছেঁড়া থাকছে, ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় ব্যাগেজ আসছে। দেরিতে ব্যাগেজ আসা এবং চেক-ইন ব্যাগ দেরিতে প্লেনে পৌঁছানোর অভিযোগও রয়েছে।
শুনানিতে একাধিক বিদেশি এয়ারলাইন্স অভিযোগ করেছে, বিমান তাদের কাছ থেকে চার্জ নিলেও সময়মতো গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দিচ্ছে না। ব্যাগেজ প্লেনে পৌঁছতে দেরি হওয়ার কারণে এয়ারলাইন্সগুলো সময়মতো ফ্লাইট ছাড়তে পারছে না। পাশাপাশি ব্যাগেজ বেল্টে দেরিতে লাগেজ দেওয়ায় যাত্রীরা এয়ারলাইন্সের ওপর ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। এতে অনেক এয়ারলাইন্সের সুনাম নষ্ট হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে (গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং) প্রায়ই যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও চুরির অভিযোগ শোনা যায়। সর্বশেষ চলতি বছরের ২ সেপ্টেম্বর চেন্নাইগামী ফ্লাইটের এক যাত্রীর ব্যাগ থেকে ছয় হাজার ৮০০ ইউরো অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় নয় লাখ ১০ হাজার টাকা চুরির অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশে হস্তান্তর করে বিমান।
বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, নতুন টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বিমানের পর্যাপ্ত সরঞ্জাম থাকতে পারে, তবে তাদের বিষয়ে যাত্রীদের মতামত (ফিডব্যাক) ভালো নয়। বিমান যেহেতু দুই বছরের জন্য দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে, টার্মিনাল পরিচালনায় তাদের সক্ষমতা ও মানসিকতা কেমন হয় সেটিই এখন দেখার বিষয়।
এ অবস্থায় এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বিমানের কাছে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম থাকলেও তাদের জনবল নেই। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ১ ও ২ নম্বর টার্মিনাল চালাতে গিয়েই তারা হিমশিম খাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া উচিত হবে না।
বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে যেসব বিদেশি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করে তারা কেউই বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তৃতীয় টার্মিনালের কাজ চলাকালীন বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও প্যাসেঞ্জার সার্ভিস নিয়ে একটি জরিপ করা হয়েছিল। জরিপে অংশ নেওয়া ৯৩ শতাংশই বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
বেবিচক জানায়, বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার কারা হবে, তাদের কীভাবে এবং কী কী সার্ভিস দিতে হবে, সেই সার্ভিস দিয়ে রাজস্ব আয় কত হবে— সেগুলো নির্ধারণে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনকে (আইএফসি) অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রিলিমিনারি রিপোর্টে থার্ড টার্মিনালের প্রাইভেট সেক্টর পার্টনারশিপের (পিএসপি) জন্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে মনোনয়ন করা হয়েছিল। তবে, বর্তমানে দুই বছরের জন্য এই দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে।
বেবিচকের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মো. মফিদুর রহমান বলেন, প্রত্যেকেই চায় দেশের বিমানবন্দরের সার্ভিসটা যেন উন্নত হয়। তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পেতে হলে বিমানে অনেক কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। তাদের ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট করতে হবে। আইএফসি সবকিছু বিবেচনা করে তাদের অভিজ্ঞতার আলোকেই রিপোর্ট দিয়েছে। তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণের জন্য যে ঋণ নেওয়া হয়েছে সরকারকে টার্মিনালের রাজস্ব থেকে সেই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার নিয়োগ না দিলে তা রাজস্বে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এটা নিয়ে বেবিচক ভবিষ্যতে ঝামেলায় পড়ে যাবে। বর্তমান সক্ষমতা নিয়ে বিমান প্রত্যাশিত সার্ভিস দিতে পারবে না।
থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্যাসেঞ্জার হ্যান্ডলিং কোনোভাবে করলেও কার্গো হ্যান্ডলিং করার মতো এখনও সক্ষম হয়নি। থার্ড টার্মিনাল চালু এরই মধ্যে বিলম্ব হয়ে গেছে, আমরা নিয়মিত রাজস্ব হারাচ্ছি। এ পর্যায়ে এসে পরীক্ষামূলকভাবে বিমানকে অন্তত কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া উচিত হবে না।
আপনার মতামত লিখুন