৫৯ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অনুসন্ধান করবে দুদক
গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত অভিযোগটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে দুদক। সোমবার (১৯ আগস্ট) দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কমিশন সভায় বিষয়টি উপস্থাপিত হতে পারে বলে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি বা ৫৯ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ নিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছে বলেও জানায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র। অভিযোগ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় ও ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের মধ্যস্থতায় ওই টাকা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কমিশন নেবে। তবে যেহেতু দুদকের আগে থেকে চলমান রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আবাসন প্রকল্পের আলোচিত বালিশকাণ্ডে ৩১ কোটি ২৪ লাখ টাকার দুর্নীতির তদন্তকাজ দীর্ঘদিন ধরে চলমান রয়েছে, এই অবস্থায় নতুন করে ৫৯ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি অভিযোগ উঠেছে। যেখানে অনুসন্ধান করার মতো তথ্য-উপাত্তও রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কমিশন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার করছে। আজ (সোমবার) এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি আত্মসাৎ করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (১৮ আগস্ট) গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, রাশিয়ার সহযোগিতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণে খরচ ধরা হয় এক হাজার ২৬৫ কোটি ডলার। প্রয়োজনের তুলনায় যা অনেক বেশি। যাতে মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এই বাজেট থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের সুযোগ করে দেয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রোসাটম।
নিজের ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে এ চুক্তি করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এ মধ্যস্থতার বিনিময়ে পাচার করা অর্থের ৩০ শতাংশ পেয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক, শেখ রেহানা ও পরিবারের কয়েকজন সদস্য।
২০১৩ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সাক্ষাতের সময় সঙ্গী ছিলেন টিউলিপ সিদ্দিক। গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের দাবি, সে সময় ঢাকা-মস্কোর বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তির মধ্যস্থতাও করেন তিনি।
২০০৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া লিমিটেড’ নামে একটি ভুয়া কোম্পানি চালু করেন টিউলিপ সিদ্দিক, তার মা শেখ রেহানা ও চাচা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক। যুক্তরাষ্ট্রেও জুমানা ইনভেস্টমেন্ট নামে একটি কোম্পানি রয়েছে তাদের।
গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের অভিযোগ, এ কোম্পানির মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশের অফশোর অ্যাকাউন্টে অর্থ পাচার করতেন শেখ হাসিনা। তাদের এ কোম্পানিটি ডেসটিনি গ্রুপ নামে একটি চিটিং ফান্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার পাচার করেছে।
এদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আবাসন প্রকল্পে লুটপাট যা বালিশকাণ্ড হিসেবে আলোচিত ঘটনায় ৩১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ১৭২ টাকার দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর পাবনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দুদকের উপপরিচালক নাসির উদ্দিন ও উপসহকারী পরিচালক শাহজাহান মিরাজ বাদী হয়ে পৃথক চারটি মামলা দায়ের করেন। চার মামলায় পাবনা গণপূর্তের ১১ প্রকৌশলী ও ২ ঠিকাদারসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছিল। মামলা দায়ের করার পর কয়েক দফায় তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা ছাড়া তেমন অগ্রগতি হয়নি।একের পর এক তদন্ত কর্মকর্তা বদলে মামলার কাজে তৈরি হয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা।
২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর বালিশকাণ্ড দুর্নীতির ঘটনায় দুদকের মামলার তদন্ত ৬ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। বেঁধে দেওয়া সময় পেরিয়ে গেলেও আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়নি।
আসামিরা হলেন- পাবনা গণপূর্তের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলম, পাবনা গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. জাহিদুল কবির, পাবনা গণপূর্তের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (সিভিল) মো. মোস্তফা কামাল, পাবনা গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম, পাবনা গণপূর্তের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আহমেদ সাজ্জাদ খান, পাবনা গণপূর্তের এস্টিমেট ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী সুমন কুমার নন্দী, পাবনা গণপূর্তের সহকারী প্রকৌশলী মো. তারেক, পাবনা গণপূর্তের সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. আমিনুল ইসলাম, পাবনা গণপূর্তের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবু সাঈদ, পাবনা গণপূর্তের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (সিভিল) মো. তাহাজ্জুদ হোসেন, পাবনা গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. রওশন আলী এবং ঠিকাদার সাজিন কনস্ট্রাকশন এর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন ও মজিদ অ্যান্ড সন্স কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী আসিফ হোসেন।
মামলার আসামি করা নিয়েও ছিল বিতর্ক। রূপপুর বালিশকাণ্ডের হোতা হিসেবে পরিচিত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জিল্লুর রহমানসহ বেশ কয়েকজনকে আসামি না করা নিয়ে বিভিন্ন গুঞ্জন চলমান রয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের গ্রিন সিটির আওতায় ১২৫০ বর্গফুটের ৬ ইউনিটের ২০ তলা ভবনের বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রীর ৩৪টি শিডিউলে ও আটটি ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রীর বাজারমূল্যের চেয়ে অধিক মূল্য দেখিয়ে ৮ কোটি ১২ লাখ ৬৯ হাজার নয়শত পঞ্চাশ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে।
অনুরূপভাবে একই প্রকল্পের আওতায় ৭৫০ বর্গফুটের ছয় ইউনিট বিশিষ্ট ২০ তলা ভবনের ৬৩টি সিভিল ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর মধ্যে ২৪ টি সিভিল ও আটটি ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর অধিক মূল্য দেখানো হয়েছে। যেখানে আত্মসাৎ হয় ৭ কোটি ৮৪ লাখ ৮ হাজার ৭১৬ টাকা।
একই প্রকল্পে সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমের নেতৃত্বে একটি চক্র ৮৫০ বর্গফুটের বিশ তলা ভবন নির্মাণের অধীনে ৭৫টি শিডিউল ও নন শিডিউল আসবাবপত্র এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীসহ বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে ৪৩টি আইটেমে বাজার মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্য দেখিয়ে ৭ কোটি ৪৮ লাখ ১৬ হাজার ৬৮ টাকা আত্মসাৎ হয়।
আর আসবাবপত্র, ভবন নির্মাণ সামগ্রী ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীসহ ৭০টি সামগ্রীর অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে ৭ কোটি ৭৯ লাখ ৪২ হাজার চারশত ৩৮ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। এভাবে মোট চারটি মামলায় ৩১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ১৭২ টাকা ৪৭ পয়সা আত্মসাৎ অভিযোগ আনা হয়েছিল। বালিশকাণ্ডে ১৩ আসামিকে গ্রেপ্তার হলেও বর্তমানে তারা জামিনে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
আপনার মতামত লিখুন