আমাদের সড়ক নিরাপদ হবে কবে?
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। আয়তনের তুলনায় আমাদের জনসংখ্যার আধিক্য আমাদের উন্নয়নের বড় অন্তরায়। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করছে। এতে নিঃসন্দেহে জনসংখ্যা আর বোঝা হয়ে থাকছে না। কিন্তু তাতে জনসংখ্যা কোনো মতেই কমছে না।
এসব মানুষ রাস্তায় তথা সড়কে নামে। বাজার করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়, কর্মস্থলে যায় অর্থাৎ নিয়মিত চলাচল থাকে। এত সড়কে ভীড় বাড়ে। এই ভীড় সামাল দেয়ার অবস্থা আমাদের নেই।
ফলে একদিকে আমাদের কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে আগে যাওয়ার প্রতিযোগীতায় সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রায় সব দেশেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশের মতো কোথাও এর হার এত ঊর্ধ্বমুখী কি না, এ এক বিরাট প্রশ্ন।
প্রশ্ন হচ্ছে, সড়ক কি মৃত্যুফাঁদ হয়েই থাকবে? আমরা দেখছি, দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ক্রমবর্ধমান হারের প্রেক্ষাপটের পেছনে যানবাহনের চালক ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অনেকের দায়িত্বহীনতা-স্বেচ্ছাচারিতা-শৃঙ্খলাভঙ্গের অপপ্রবণতা বহুলাংশে দায়ী।
একেকটি দুর্ঘটনায় প্রতীয়মান হচ্ছে এগুলোর কোনোটিই নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং বলা যায় অবহেলা জনিত হত্যাকান্ড।
সংবাদমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই সড়কে বিশৃঙ্খলার যে চিত্র উঠে আসছে, তা এক কথায় বলা যায় চরম নৈরাজ্য। সড়কে নিরাপত্তা নিয়ে এ-যাবৎ কথা কম হয়নি। আলাপ-আলোচনায় সড়ক নিরাপদ করার বহুমাত্রিক সমাধানসূত্রও উঠে এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দিনকে দিন সড়কের মৃত্যুফাঁদ হয়ে ওঠা ঠেকানো যাচ্ছে না। সড়কে যানবাহন চলাচল আইন আছে, পথচারীদের জন্যও আছে আইন। তারপরও অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের দৌরাত্ম্য, ট্রাফিক আইন না মানার অপপ্রবণতার পাশাপাশি কোনো কোনো ক্ষেত্রে রয়েছে জনসচেতনতারও ঘাটতি। অধিকাংশ চালকের যেমন নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স, এর সমান্তরালে অদক্ষ চালকের সংখ্যাও কম নয়। কিছুদিন আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে গড়ে প্রতিদিন সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে ৫৫ জন মানুষ। প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায় জানা গেছে, দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় গড়ে ১২ হাজার মানুষ। আর ‘নিরাপদ সড়ক চাই’র (নিসচা) তথ্যে প্রকাশ, গত এক বছরে দেশের সড়ক, নৌ ও রেলপথে ৭ হাজারেরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে এবং তাতে হতাহতের সংখ্যাও ক্রমেই স্ফীত হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, যাতায়াতের কোনো পথই নির্বিঘ্ন করা যাচ্ছে না, তবে এর মধ্যে সড়কপথের অবস্থা ভয়াবহ।
দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হত্যাকাণ্ড বলে প্রমাণিত হলে চূড়ান্ত দণ্ডের বিধান রয়েছে এবং এর দায় শুধু চালকেরই নয়, গাড়ির মালিক এবং কোম্পানিসংশ্লিষ্ট অন্যদেরও। অথচ এক্ষেত্রে আইনটি যেন কাজির গুরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।
সড়ক দুর্ঘটনা কেন ঘটে? কী কী কারণে এত বেশি দুর্ঘটনা, কী কী পদক্ষেপ নিলে দুর্ঘটনার হার কমানো সম্ভবÑ এর সবই বহুল আলোচিত। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন তো বটেই এর সঙ্গে সড়ক-মহাসড়কে গাড়িচালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, অনৈতিক ব্যবসাপ্রবণতা এবং আইন কিংবা নিয়মনীতি ভঙ্গের অপপ্রবণতা পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যেন মজ্জাগত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সড়ক-মহাসড়কে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের ছায়া ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আইন মানা এবং আইন মানানোর প্রবণতা এই দুই ক্ষেত্রেই ব্যাপক ঘাটতি স্পষ্টত দৃশ্যমান। আমাদের ট্রাফিক বিভাগে প্রয়োজনের তুলনায় জনবল কম, এ কথা অসত্য নয় বটে, কিন্তু যে সংখ্যক আছেন তাদেরই বা জবাবদিহি কোথায়? ট্রাফিক আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও আইন রক্ষকদের অনেকেরই ঢিলেঢালা ভাব ও দুর্নীতির কারণে গাড়িচালকদের মধ্যে আইন ভাঙার প্রবণতা বাড়ছে।
মানুষের জীবনরক্ষায় সড়কে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। আমরা সড়ক পরিবহন আইনের কার্যকারিতা এবং সুফল দেখতে চাই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
আপনার মতামত লিখুন